ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

নিয়োগ পরীক্ষায় ১ম হয়েও হলো না সরকারী চাকুরী, জয় ক্ষমতা আর প্রতিশোধের!

আমাদের খবর ২৪

প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০২৩, ০৩:০০ পিএম

নিয়োগ পরীক্ষায় ১ম হয়েও হলো না সরকারী চাকুরী, জয় ক্ষমতা আর প্রতিশোধের!

সরকারী চাকুরী যেন সোনার হরিণ, আর এই অধরাকে ধরা দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেন বাংলাদেশের তরুণ সমাজ। সরকারী চাকুরীর সকল পর্যায়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া সুষ্ঠু করতে সরকার গ্রহণ করেছে বিভিন্ন উদ্যোগ, কিন্তু কিছু অসাধু মানুষের চক্রান্তের কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া হয় প্রশ্নবিদ্ধ, যার কারণে সরকারের ভাবমুর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। এমনই এক নিয়োগ প্রক্রিয়া ও অসাধু কার্যকলাপে বলি হয়েছেন এক প্রতিবন্ধি (বধির), মোঃ আবু বকর আকন্দ, যিনি সরকারী চাকুরীর পরীক্ষায় সম্মিলিত স্কোরে ১ম হয়েও পাননি চাকুরী।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরে বিগত ৩১/১০/২০২২ তারিখে প্রকাশিত হয় ‘অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক’ পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের কিছুদিন পরেই কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অন্যত্র বদলি হয়ে যাওয়ায় অধিদপ্তরটি অভিভাবকহীন হয়ে যায় এবং এই সুযোগেই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিজের দখলে নিয়ে নিজের খেয়াল খুশি মতো রাজ্য গড়ে তুলেন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা, যার নাম মোঃ মজিবর রহমান। যে পদে তাঁর থাকার যোগ্যতাই নেই, দিব্যি আঁকড়ে ছিলেন সেই পদে। আর এই পদে থেকে প্রতিনিয়ত করেছেন ক্ষমতার অপব্যবহার। ২০১০ সাল থেকে অদ্যবধি দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে তিনি সদরদপ্তরে একটানা কর্মরত আছেন। এই দীর্ঘ সময়ে পদোন্নতি ছাড়াই নানান সময় নানান পদবী ব্যবহার করে সরকারী কার্যপ্রক্রিয়া কলুষিত করে আসছেন।

মো: মজিবর রহমান, যিনি দীর্ঘ ১৩ বছর সহকারী পরিচালক পদে সদরদপ্তরে চাকুরী করেছেন। এই সময়ে তাঁর আচরণগত সমস্যায় ভুগেননি এমন কর্মচারী পাওয়া দুষ্কর। বাবা-মা তুলে গালিগালাজ করা, লাথি মেরে চেয়ার থেকে অফিস সহকারীকে ফেলে দেয়া থেকে শুরু করে গায়ে হাত তোলার রেকর্ডও আছে তাঁর দখলে। এই তথ্যগুলো জানা যায় তার সাথেই কাজ করেছেন এমন এক অফিস সহকারীর নিকট থেকে। এই অফিস সহকারীর আপন ছোটভাই ভুক্তভোগী আবু বকর আকন্দ, যিনি এই বিতর্কিত নিয়োগ প্রক্রিয়ায় চাকুরীপ্রার্থী হিসেবে আবেদন করেন, প্রতিবন্ধি কোটায় (বধির) আবেদন করলেও লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ৮৫ নাম্বার পান, ব্যবহারিক পরীক্ষাও নিজ যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষায় তাকে কোন যৌক্তিক কারণ ছাড়াই বাদ দেয়া হয়। অভিযুক্ত মজিবর রহমান জানতে পারেন যে আবু বকর আকন্দ তাঁর দ্বারা নির্যাতিত অফিস সহকারীর ছোট ভাই। তারপর থেকেই তাকে চাকুরীতে না নেয়ার জন্য সব পায়তারা করতে থাকেন। এই বিষয়ে তাঁকে সার্বিক সহযোগিতা করেন রুটিন দায়িত্বে থাকা ওমর মোঃ ইমরুল মহসিন এবং সাগরেদ কিশোর কুমার সাহা। মৌখিক পরিক্ষায় তাকে হেনস্তা করা হয় এবং মৌখিক পরীক্ষায় ৪০% নাম্বার দেয়া হয়। যেই ছেলে লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নাম্বার পায়, ব্যবহারিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় এবং মৌখিক পরীক্ষায় ৪০% পায়, চুড়ান্ত সম্মিলিত নাম্বারে তাঁর জায়গা হলো না। এমনটা কেনো?

বলা হয় যে সে মৌখিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে। মৌখিক পরীক্ষায় ৪০% নাম্বার পেলে অকৃতকার্য হয় এমন সরকারী গেজেট কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আরও বলা হয় যে, আবু বকর আকন্দ অন্য কাউকে দিয়ে লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে এবং লিখিত পরীক্ষার খাতার সাথে মৌখিক পরীক্ষায় নেয়া হাতের লেখার মিল নেই। কিন্তু লিখিত পরীক্ষা মূল্যায়নের সার্বিক কার্যক্রম স্বয়ং মজিবর রহমানের তত্ত্বাবধানে হয় এবং হাতের লেখা অমিলের বিষয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট হতে যাচাই করা হয়নি। আরও বলা হয় যে, আবু বকর আকন্দ বধির হওয়ার ভুয়া সার্টিফিকেট প্রদান করেছেন, কিন্তু সেটাও যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট হতে যাচাই করা হয়নি। আমরা যাচাই করে নিশ্চিত হয়েছি যে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট হতেই সার্টিফিকেট গ্রহণ করা হয়েছে এবং আমাদের গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধি ভুক্তভোগী আবু বকর আকন্দের স্থায়ী ঠিকানায় গিয়ে নিশ্চিত হয় যে তিনি একজন বধির। প্রশ্ন আসতে পারে, মজিবর রহমান এবং তাঁর দলবল কিভাবে এতোকিছু করলেন?


নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরে তদকালীন মহাপরিচালক আঃ গাফফার খান অন্যত্র বদলী হয়ে চলে যান এবং অধিদপ্তরের পরিচালক ওমর মোঃ ইমরুল মহসিন রুটিন দায়িত্ব হিসেবে মহাপরিচালকের পদে আসীন হন। তাঁর সাথে পুর্বে থেকেই মজিবর রহমানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল এবং রুটিন দায়িত্ব থাকা স্বত্তেও পুর্ণাংগ মহাপরিচালকের সকল সুযোগ সুবিধা অনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে উদ্ধুদ্ধ করেন মজিবর রহমান। মহাপরিচালকের দপ্তরে ঢুকে তাঁর চেয়ারে আসীন হয়ে ৩টি গাড়ি ব্যবহার শুরু করেন ওমর মোঃ ইমরুল মহসিন, যা করতে তাকে সহযোগিতা প্রদান করে দূর্নীতিপরায়ন মজিবর রহমান এবং তারই পৃষ্ঠপোষকতায় উদীয়মান সহকারী পরিচালক (প্রশিক্ষণ) কিশোর কুমার সাহা।

বিগত ২৬/০২/২০২৩ তারিখে মাসুদ করিমের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে পদায়ন হলেও অনিবার্য কারণে তাঁর যোগদান বিলম্বিত হচ্ছিল। এই সুযোগেই মজিবর রহমান নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরিকল্পনা করেন। নতুন মহাপরিচালকের পদায়ন আদেশ হওয়ার ৫ (পাঁচ) দিন পরেই ০৩/০৩/২০২৩ তারিখ লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। লিখিত পরীক্ষার ফলাফল তড়িঘড়ি করে মাত্র ৩ (তিন) দিনের মধ্যে প্রকাশ করা হয় ০৬/০৩/২০২৩ তারিখে। মাত্র দশ দিনের ব্যবধানে ১৭/০৩/২০২৩ এবং ১৮/০৩/২০২৩ তারিখ ব্যবহারিক পরীক্ষা গ্রহণ করে ঐদিনই ব্যবহারিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ঠিক পাঁচ দিন পরে ২৩/০৩/২০২৩ মৌখিক পরিক্ষা আয়োজন করে দুই দিনের মধ্যে ২৫/০৩/২০২৩ তারিখ চুড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করে পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া চুড়ান্ত করা হয়। এই সম্পুর্ণ সময়ে মূল মহাপরিচালকের পদ ছিল ‘শুন্য’ এবং সেই পদে ক্ষমতাসীন হয়ে ওমর মোঃ ইমরুল মহসিন এবং মজিবর রহমান নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। কেনো ছিল তাদের এতো তাড়াহুড়া? কেনো পারলেন না নতুন মহাপরিচালকের যোগদানের অপেক্ষা করতে? কেনোই বা মূল মহাপরিচালকের সম্মতি গ্রহণ করা হলো না?

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত বিভাগীয় নির্বাচন কমিটি গঠনের বিধান অনুযায়ী অধিদপ্তর পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে সদস্য সচিব হিসেবে একজন উপ-পরিচালক থাকার কথা যা ৫ম গ্রেডের পদ। নিয়োগ প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে মজিবর রহমান ৯ম গ্রেডের হলেও ৫ম গ্রেডের উপ-পরিচালকের পদবী ব্যবহার করে সকল কার্যসম্পাদন করেন। তিনি একাধারে অধিদপ্তরের বাজার সংযোগ শাখা এবং প্রশাসন ও হিসাব শাখার উপ-পরিচালকের পদবী ব্যবহার করে নানান দাপ্তরিক পত্রে স্বাক্ষর প্রদান করতে থাকেন। এই ‘ভুয়া’ উপ পরিচালকের পদ ব্যবহার করে তিনি নিয়োগ পরীক্ষার প্রবেশপত্র থেকে শুরু করে চুড়ান্ত ফলাফলে স্বাক্ষর করেন। বিষয় কিন্তু এমন না যে ওই সময় অধিদপ্তরে অন্য কোন উপ-পরিচালক ছিলেন না। সরকারের ৩ জন উপ সচিব অধিদপ্তরে উপ-পরিচালক পদে ছিলেন। তাদের সবাইকে টপকে মজিবর রহমানকে নিয়োগ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেন মহাপরিচালক পদে জবর দখল করে আসীন হওয়া তদকালীন পরিচালক ওমর মোঃ ইমরুল মহসিন। প্রশ্ন আসে, কোন আইনের আলোকে ৯ম গ্রেডের একজনকে ৫ম গ্রেডের পদে বসানো যায়? কৃষি মন্ত্রণালয় কি এ ব্যাপারে অনুমোদন দিয়েছিল? উত্তর হলো, না। অনুমোদন তো দুরের কথা, উপ-পরিচালকের পদে পদায়নের কোন অফিস আদেশের অনুলিপি মন্ত্রণালয়ে বা সচিবের দপ্তরে প্রেরণ করা হয়নি।

এতো কিছু হওয়ার পরেও কেনো কেউ মুখ খুললেন না প্রশ্ন আসতে পারে। যেই আপত্তি জানিয়েছেন, মুখ খুলেছেন তাকেই বদলী করে দেয়া হয়েছে। মজিবর রহমানের সাথে দীর্ঘদিন কাজ করে আসা আবু বকর আকন্দের বড় ভাই লুৎফর রহমানকে বদলী করে দেয়া হয় ফরিদপুরে। ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অদাপ্তরিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে মুখ খোলার কারণে অপমান করে স্ট্যান্ড রিলিজ করে মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী শাহানা আফরোজাকে সদরদপ্তর থেকে বের করে দেয়া হয় এবং আরেক অফিস সহকারী ইবরাহীম খলিলকে একইভাবে পাঠিয়ে দেয়া হয় বরিশালে।

আগামী কয়েক মাস পরেই কৃষি বিপণন অধিদপ্তরে প্রায় ১৫০টি পদে নিয়োগ প্রদান করা হবে। এরকম চলতে থাকলে মজিবর রহমান গং অধিদপ্তরে নিয়োগ ব্যবসা শুরু করতে সময় লাগবে না। আগামী নিয়োগে যেন যোগ্যতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের তরুন সমাজ চাকুরী পেতে পারে এমন বিতর্কমুক্ত একটি নিয়োগ প্রদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন এবং যেই বধির মেধাবী ছেলে আবু বকর আকন্দ তাঁর ন্যায্য পাওনা পেলো না এ ব্যাপারে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।


 

Link copied!