ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

নেপালে ভূমিকম্পের পর এখন থালা বাটি দিয়ে খুঁড়ে বের করা হচ্ছে মৃতদেহ

আমাদের খবর ২৪

প্রকাশিত: নভেম্বর ৬, ২০২৩, ০৮:৩৪ পিএম

নেপালে ভূমিকম্পের পর এখন থালা বাটি দিয়ে খুঁড়ে বের করা হচ্ছে মৃতদেহ

নেপালের পশ্চিমাঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্পে দেড় শতাধিক মানুষ নিহত এবং সাড়ে তিনশোরও বেশি আহত হয়েছেন। হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে বাইরে ঠান্ডার মধ্যে রাত কাটাচ্ছেন।

নেপালে রিখটার স্কেলে ছয় দশমিক চার মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে শুক্রবার মানে তেসরা নভেম্বর মাঝরাত নাগাদ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে জানিয়েছে, ভূমিকম্পটি ছিল পাঁচ দশমিক ছয় মাত্রার একটি স্বল্প গভীরতার ভূমিকম্প। অর্থাৎ এটির উৎপত্তি স্থল ভূপষ্ঠ থেকে কম গভীরে ছিল।

কাঠমান্ডু থেকে প্রায় তিনশ কিলোমিটার পশ্চিমে, জাজারকোট এবং পশ্চিম রুকুম জেলাগুলোতে শুক্রবারের পর থেকে বেশ কয়েক দফা আফটারশক বা ভূমিকম্প পরবর্তী কম্পন অনুভূত হয়েছে। যার প্রভাবে ওইসব অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ভূমিকম্পে মৃতদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া:
চিউরি গ্রামের পাদদেশে যথারীতি প্রবাহিত হচ্ছে থুলি ভেরি নদী। এই গ্রামটি জাজারকোটের নালগড় পৌরসভার অধীনে পড়েছে। এই নদী যত দূর বয়ে যায়, ততই মানুষের হাহাকারে ভারি হয়ে আসে আশেপাশের বাতাস। নদী তীরে নারী ও শিশুসহ ১৩ জনের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন শোকার্তরা।

এরমধ্যে অনেক নারী শোকে কাতর হয়ে মূর্ছা যাচ্ছেন। তাদেরকে পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হচ্ছে। চিউড়ি গ্রামে নারী ও শিশুসহ ১৩ জনকে একসঙ্গে দাহ করা হয়।

ছয়টি মৃতদেহ একটি চিতার ওপর এবং বাকিগুলো আলাদা আলাদা চিতায় রাখা হয়েছে। শুক্রবার রাতে ওই গ্রামের ভুক্তভোগীদের সবাই প্রাণ হারান।

চিউড়িতে ১৮৬টি বসতঘর রয়েছে। দলিতদের এই বসতিতে, হিরে কামি তার স্ত্রী এবং তাদের দুই সন্তান মারা গিয়েছে। তার প্রতিবেশী এবং আত্মীয়দের ধারণা যে দ্রুত সাড়া পেলে হিরে কামিকে হয়ত বাঁচানো যেত।

হরি বাহাদুর চুনারা সেই ভয়ানক রাতের কথা স্মরণ করে বলছিলেন, “মাঝরাতে পুরো গ্রামে হাহাকার আর কান্নার বিলাপ ছড়িয়ে পড়ে। আমরা কেউই ঠিকমত চিন্তা করতে পারছিলাম না।”

“হিরে কামিকে আমরা দেখেছি সে ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আছে। সে তখনও কথা বলছিল।’ সে সময় অনেকেই হিরা কামিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন হাট্টিরাম মাহার নামে এক যুবক।

তিনি বলেছেন, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা পরিবারটিকে উদ্ধার করতে গ্রামবাসীরা থালা, বাটি ও গৃহস্থালির জিনিসপত্র- যে যা পেয়েছে তা দিয়েই ধ্বংসাবশেষ খুঁড়ে তাদের বের করে আনার চেষ্টা করছে।

“উনি ‘আমি এখানে!” বলে তার অবস্থানের কথা আমাদের জানাচ্ছিলেন আর আমরা সেখানে গিয়ে খুড়ছিলাম।” মাহার সাংবাদিকদের দেখিয়েছেন যে হিরে কামীর শরীর কোথায় আটকে গিয়েছিল।

তিনি আমাদেরকে বলেন আমরা যেন ‘ওই জায়গায় পা না দেই’। কারণ তার মনে সেই মুহূর্তটি বার বার ঘুরেফিরে আসছিল যে তিনি তার আত্মীয়কে বাঁচাতে পারেননি।

ধরা গলায় তিনি বলেন, “তাকে আমাদের এভাবেই বিদায় জানাতে হয়েছে।” তার মতো, হিরে কামিও ভারতে কাজ করতেন এবং মাত্র কয়েকদিন আগে ভারত থেকে নেপালে এসেছিলেন।

তার পরিকল্পনা ছিল নেপালের অন্যতম বৃহত্তম উৎসব তিহাইর উদযাপন শেষে তিনি আবার ভারতে ফিরে যাবেন। তার মেয়েদের সবচেয়ে বড় জন কোনভাবে জীবিত ফিরতে পেরেছেন।

তার একটি মাত্র বোন ছাড়া তার পুরো পরিবার এখন মারা গেছে, জানতে পেরে তিনি মূর্ছা যান। চিকিৎসার জন্য তাকে অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল।

যখন শেষকৃত্যের চিতা নিভে যেতে শুরু করে, শোকাহত গ্রামবাসীরা রাস্তা পার হয়ে পাহাড়ি পথ ধরে তাদের গ্রামের দিকে হাঁটতে থাকে- যার পুরোটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

বেঁচে ফেরা মানুষ এখন সাহায্যের অপেক্ষায়:
ত্রাণ পাওয়ার আশায় থাকা হরি বাহাদুর চুনারা বলেছেন, তাদের আশ্রয় নেওয়ার জায়গা ছিল না। তিনি জানেন না যে তাদের ত্রাণের সাথে নতুন করে ঘর নির্মাণের উপকরণ আসবে কিনা।

ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জাজারকোটের এই নালগড় পৌরসভা। পৌরসভার তথ্য কর্মকর্তা জুনা শাহী জানিয়েছেন, এখানে ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে এখন উদ্বেগের বিষয় হল, যারা বেঁচে আছেন তাদেরকে কীভাবে রক্ষা করা যায়।

বিশেষ করে ছোট শিশুদের কীভাবে ঠান্ডা থেকে রক্ষা করবেন তা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হাট্টিরাম মাহার। তিনি বলেন, “তাদের বাইরে রাত কাটাতে হবে। তাঁবু থাকলে সাহায্য হত।”

অন্যদিকে, থুলি ভেরি নদীর উল্টো তীরে আথবিসকোট পৌরসভার বাসিন্দা গণেশ মাল্লাকে হেলিকপ্টারে উদ্ধার করা হয়। তিনি এখন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি কাঁন্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার দুই মেয়ে মারা গিয়েছে, আমার স্ত্রী ও ছেলেও আহত, আমি জানি না তাদের কোথায় চিকিৎসা করা হচ্ছে।”

ভূমিকম্পের পর সকালে আহতদের যখন হাসপাতালে আনা হয় তখন তাৎক্ষণিকভাবে তাদের কারও পরিচয় পাওয়া যায়নি। হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জন পদম গিরি বলেন, “শুরুতে, আমরা ‘কেস-১’, ‘কেস-২’ বলে সিরিয়াল নম্বর লিখে চিকিৎসা শুরু করেছিলাম।”

“অনেক শরীরে কাপড়ও ছিল না, তাই আমরা তাদের জন্য কাপড়ের ব্যবস্থা করি।” তিনি জানান, আহত প্রায় ৩০ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আহতদের মধ্যে কয়েকজন এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন

নেপালে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল:
বলা হচ্ছে, ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল বারকোটে ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলক কম। গণেশ জিসি নামের এক শিক্ষক বলেছেন, প্রায় সব ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় মাটি ও পাথরের বাড়ি ধসে পড়েছে।

এমন অনেক ঘর কাঁচের মতো গুড়ো গুড়ো হয়ে ভেঙে পড়েছে। কিছু কিছু বাড়ির দেয়াল ধসে গেছে আবার কিছু বাড়িতে ফাটল ধরেছে। তবে কংক্রিট ও সিমেন্টের ঘরগুলোয় বড় কোন ক্ষয়ক্ষতি হতে দেখা যায়নি। গণেশ জিসি বলেন, “যখনই বন্যা এবং ভূমিধস হয়, ক্ষতির মুখে পড়ে শুধু গরিবরা। ভূমিকম্পও গরিবদের ওপরেই হামলে পড়েছে।”

নেপালকে একরকম ধ্বংস করে দিয়েছিল ২০১৫ সালের যে ভয়াবহ ভূমিকম্প, তারপর শুক্রবার রাতের ভূমিকম্পকে নেপালের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্প হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।


 

Link copied!