ফাইল ছবি
বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম আলু উৎপাদনকারী দেশ। রপ্তানি করছে ২৬ বছর ধরে। একসময় রপ্তানি এক লাখ টনও ছাড়িয়েছিল। এরপর না বেড়ে বরং ক্রমান্বয়ে কমেছে। গত বছর রপ্তানি নেমেছিল মাত্র ১২ হাজার টনে। বছর ঘুরতেই চারগুণ বাড়লো আলু রপ্তানি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এবছর এখন পর্যন্ত (৫ মে) ৪৮ হাজার ১৭৭ টন আলু রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের মোট রপ্তানির চারগুণ। এ বছরের রপ্তানি এখনো চলমান। মৌসুম শেষে রপ্তানির পরিমাণ ৬০ হাজার টন ছাড়িয়ে যেতে পারে।
তথ্য বলছে, গত বছর (২০২৪ সাল) আলু রপ্তানি হয় ১২ হাজার ১১২ টন, এর আগের বছরগুলোতে ছিল যথাক্রমে ৩২ হাজার ৩৯২ টন, ৬২ হাজার ৭২৬ টন, ৫১ হাজার ৭৬৩ টন এবং ৫৬ হাজার টন।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, মূলত দেশে আলুর উৎপাদন ভালো হওয়া, উৎপাদন খরচের তুলনায় স্থানীয় বাজারে আলুর দাম কম থাকায় রপ্তানি বেড়েছে। এছাড়া বিশ্ববাজারে আলুর চাহিদা বৃদ্ধি, নতুন জাত উন্নয়ন, কার্গো ভাড়া কমাসহ কিছু সরকারি সুবিধার কথাও জানিয়েছেন তারা।
আলু রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জিল ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ হায়দার বলেন, ‘এবার রপ্তানি বাড়ার প্রধান কারণ আলুর দাম কমে যাওয়া। তাছাড়া এবার আমদানিকারক দেশগুলোতে প্রচুর আলুর চাহিদা রয়েছে। ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনার সুফলও পাচ্ছেন রপ্তানিকারকরা। পাকিস্তান সেভাবে আলু রপ্তানি করছে না এবছর। সেই অর্ডারগুলো বাংলাদেশে আসছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী পাকিস্তান।’
এ রপ্তানিকারক আরও বলেন, ‘এবার অন্য বছরের তুলনায় জাহাজ ভাড়া কম। প্রতি টন আলু ২৬০ থেকে ২৮০ ডলারে রপ্তানি করা যাচ্ছে। ডলারের দাম ভালো হওয়ার কারণে মুনাফাও ভালো হচ্ছে।’
বাংলাদেশ আলু রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি ও ফেরদৌস বায়োটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফেরদৌসী বেগম বলেন, ‘আরও প্রায় ১০ হাজার টনের বেশি আলু রপ্তানি হবে এ মৌসুমে। মালয়েশিয়ায় আরও এক মাস ও নেপালে জুলাই পর্যন্ত আলু রপ্তানি হবে।’
তিনি বলেন, ‘গত বছর বিআইডিসি ‘সানসাইন’ নামে একটি জাতের আলুর উৎপাদন বাণিজ্যিকভাবে শুরু করেছে। এবছর ওই আলু প্রচুর রপ্তানি হচ্ছে। জাতটির সাইজ ও রং খুব ভালো। ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে।’
ফেরদৌসী বেগম বলেন, ‘এ বছর অনেক অর্ডার রয়েছে, যেগুলো সরবরাহে রপ্তানিকারকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। আর সরকার এবছর আলু রপ্তানির জন্য বিআরটিসির ট্রাকগুলো বন্দরে পণ্য নিতে যাওয়ার সময় আলু বোঝাই করে নিয়ে যাওয়ার একটি ব্যবস্থা করেছে। এতে যে আলু বন্দরে ৪০ হাজার টাকা ভাড়ায় নিতে হতো, সেটা ২০-২৫ হাজারে নেওয়া যাচ্ছে। এর বড় সুফল পাচ্ছি।’
কোন দেশে যাচ্ছে আলু
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি আলু রপ্তানি হয় মালয়েশিয়ায়। মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশ যায় দেশটিতে। এছাড়া সিঙ্গাপুর, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে রপ্তানি হচ্ছে আলু। বেশ আগে রাশিয়ায় আলু রপ্তানি হতো, তবে এখন সেভাবে ওই দেশে আলু যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ১৪টি দেশে রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশের আলু।
ইপিবি সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশ থেকে আলু রপ্তানির আয় সর্বোচ্চ ৩৩ মিলিয়ন ডলারের ওপরে ছিল। পরবর্তী বছরগুলোতে রপ্তানি আয় কমে এসে প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কিছুটা ওপরে স্থির হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে ১০ মিলিয়নের বেশি রপ্তানি হয়নি।
আলুর উৎপাদন ও চাহিদা
আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম। যদিও গত বছর প্রথম দেশে আলু আমদানির প্রয়োজন হয়েছিল। স্বাধীনতার পর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৫২ বছরে বাংলাদেশ কখনো চাহিদা মেটানোর জন্য আলু আমদানি করেনি। এরপর দেশের আলু উৎপাদনের তথ্য নিয়ে নানান প্রশ্ন ওঠে। অনেকে বলেছে, উৎপাদনের সফলতা দেখাতে বাড়তি তথ্য দিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, দেশে বর্তমানে প্রায় পাঁচ লাখ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়। গত অর্থবছর আলু উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৯ লাখ টন। মাঠপর্যায় থেকে আলু বাজারজাতকরণ পর্যন্ত প্রায় ১৫ শতাংশ অপচয় হয়। সেই হিসাবে আলু পাওয়া যায় প্রায় ৯৩ লাখ টন, যা চাহিদার প্রায় সমান।
এবছর আলু উৎপাদনের পরিমাণ এখনো নির্ধারণ করেনি অধিদপ্তর। তবে ধারণা করা হচ্ছে, উৎপাদন গত বছরের চেয়ে বেশি হবে।
রপ্তানির জন্য অপর্যাপ্ত জাত
ব্যবসায়ীরা জানান, তারা এখন সানসাইন, গ্রানোলা, ডায়মন্ড, ম্যাজেস্টিক, প্রাডা, সান্তানা, কুইন অ্যানি, কুম্বিকা, ডোনেটা ও বারি আলু-৬২ মতো উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন আলু রপ্তানি করছেন।
তারা বলছেন, দেশে রপ্তানিযোগ্য পর্যাপ্ত আলুর জাত নেই। ২৬ বছর ধরে রপ্তানি বাজারের উপযোগী জাতের অভাব রয়ে গেছে। জাতের এই সংকটের কারণে রপ্তানিকারকরা বিদেশি ক্রেতার চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না।
যদিও এখন পর্যন্ত দেশে ৯১টি নতুন আলুর জাত অবমুক্ত করা হয়েছে। অধিকাংশের চাহিদা রপ্তানি বাজারে নেই। কারণ বাংলাদেশের আলুতে শুষ্ক পদার্থের উপস্থিতি কম, যা বিদেশে নানান ফ্রাইড খাবার তৈরিতে খরচ বাড়ায়।
ফেরদৌসী বেগম জানান, বাংলাদেশে আলুতে শুষ্ক পদার্থের উপস্থিতি কম থাকার কারণে যখন এ আলু দিয়ে শিল্প-কারখানায় চিপস বা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বানানো হয়, সেটা জ্বালানি সাশ্রয়ী হয় না। এছাড়া ওইসব আলু স্টার্চ বেশি বলে মচমচে হয় না।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বিদেশ থেকে উচ্চ ফলনশীল এবং শুষ্ক পদার্থের উপস্থিতি বেশি সম্পন্ন রপ্তানি ও শিল্পে ব্যবহারযোগ্য আলুর জাত সম্প্রসারণে কাজ করছে সরকার। পাশাপাশি নতুন কিছু জাত এসেছে, যা থেকে একই পরিমাণ জমি থেকে দ্বিগুণেরও বেশি পরিমাণ আলু উৎপাদন সম্ভব হবে।’
রপ্তানিকারকরা জানান, রপ্তানি উপযোগী জাতের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন- লম্বাটে, চামড়া সাদা, অগভীর চোখ, দীর্ঘ সুপ্তিকাল, উচ্চ শুষ্ক পদার্থযুক্ত, সংরক্ষণযোগ্য ও উচ্চ ফলনশীল হতে হয়। দেশের বেশিরভাগ জাতের মধ্যে এসব গুণাবলি নেই।
এছাড়া বিশ্ববাজারে আলু রপ্তানির অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দেশের আলুতে হলোহার্টের উপস্থিতি। এটি একটি শারীরবৃত্তীয় রোগ, যা আলুর আকার বড় করা ও ফলন বাড়ানোর জন্য অনিয়ন্ত্রিত সেচ এবং সার ব্যবহারের ফলে ঘটে। প্রচলিত বেশ কিছু জাত হলোহার্টপ্রবণ। পরিমিত সার ও সেচ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হলোহার্ট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
উৎপাদনে সপ্তম, রপ্তানি তালিকায় নেই শীর্ষ দশে
তথ্য বলছে, বিশ্বে আলু রপ্তানির গড় হার বার্ষিক ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশের আলু রপ্তানি উৎপাদনের অনুপাতে কখনো এক শতাংশও হয়নি। যে কারণে আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ সপ্তম হলেও দশটি রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো স্থান নেই।
অথচ বাংলাদেশের চেয়ে কম আলু উৎপাদন করে পাকিস্তান পঞ্চম রপ্তানিকারক দেশ। পাকিস্তানে গড়ে ৮০ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়। আলু উৎপাদনের দিক থেকে তালিকায় দেশটির অবস্থান নবম। তবে দেশটি থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আলু রপ্তানিও হয়। প্রায় ১০ লাখ টনের বেশি আলু রপ্তানি করে দেশটি।
আপনার মতামত লিখুন :